কৃষি দিবানিশি
‘কৃষি দিবানিশি’ কৃষি বিষয়ক ম্যাগাজিন। আমরা বিভিন্ন রকম ফসল যেমন- ধান, গম, ভূট্রা, পাট, পেয়ারা, পেপে, কলা, কুল, বড়ই, মাল্টা,মালটা, আম, লটকন সহ আরো অনেক সবজি জাতীয় ফসল যেমন - আলু, বাঁধাকপি, শিম, মূলা, মিষ্টিকুমড়া, করলা, কাঁকরোল, ঝিঁঙ্গা, গাজর, কলমীশাক, বেগুন, ফুলকপি, বরবটি, ঢেঁড়স, চালকুমড়া, শসা, ধুন্দল, পুঁইশাক, লালশাক, টমেটো, লাউ, পটল, ক্ষীরা, পানিকচু, ডাঁটা, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি ফসলের রোগবালাই দমনে বালাইনাশক, কীটনাশক, সার, বিষ প্রয়োগ এবং ফসলের মৌসুম ও জাত সম্পর্কিত তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে থাকি।

ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক পরিচিতি

ইমিডাক্লোপ্রিড কী? 

ইমিডাক্লোপ্রিড মূলত একটি স্পর্শক, পাকস্থলীয় এবং ট্রান্সল্যামিনার ক্রিয়াসম্পন্ন নিয়োনিকোটিনয়েড শ্রেণীর অন্তর্বাহী কীটনাশক। স্প্রে করার পর পাতা ও শিকড়ের মাধ্যমে শোষিত হয়ে গাছের সর্বাংশে ছড়িয়ে পড়ে।

ইমিডাক্লোপ্রিড কীভাবে কাজ করে? 

ইমিডাক্লোপ্রিড হলো পদ্ধতিগত কীটনাশক যা নিওনিকোটিনয়েড নামক রাসায়নিক শ্রেণীর অন্তর্গত যা পোকামাকড়ের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে। কীটপতঙ্গের স্নায়ুতন্ত্রে উদ্দীপনা সংক্রমণে হস্তক্ষেপ করে রাসায়নিক কাজ করে।

বিশেষত, এটি নিকোটিনার্জিক নিউরোনাল পথের বাধা সৃষ্টি করে। নিকোটিনিক অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরকে অবরুদ্ধ করে, ইমিডাক্লোপ্রিড অ্যাসিটাইলকোলিনকে স্নায়ুর মধ্যে আবেগ প্রেরণ করতে বাধা দেয়, যার ফলে পোকাটির পক্ষাঘাত এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে। এটি যোগাযোগে এবং পেটের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে কার্যকর। যেহেতু ইমিডাক্লোপ্রিড স্তন্যপায়ী নিউরন রিসেপ্টরগুলির তুলনায় পোকামাকড়ের নিউরন রিসেপ্টরগুলির সাথে অনেক বেশি দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হয়, তাই এই কীটনাশক স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে পোকামাকড়ের জন্য বেশি বিষাক্ত

আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যতগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড় আছে,  সেগুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। 

  1. শোষক পোকা - যারা গাছের রস খেয়ে বেচে থাকে।
  2. কুরে খাওয়া পোকা - যারা গাছ, পাতা, ফল, ফুল ছিদ্র করে বা চিবিয়ে খায়।


ইমিডাক্লোপ্রিড সকল প্রকার শোষক পোকা দমনে খুব কার্যকরী। তাই এই একটি মাত্র কীটনাশক দিয়ে আপনি কৃষিক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক পোকার ট্রিটমেন্ট করতে পারবেন। তাই এর বিষয়ে একটু জেনে রাখা খুব জরুরি। 

১৯৯৯ সালের হিসাবে, ইমিডাক্লোপ্রিড ছিলো বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত কীটনাশক। 

ইমিডাক্লোপ্রিড এর অনেক কয়টি গুন আছে। এটি বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকে। যেমন:- 

প্রবাহমান

 ইমিডাক্লোপ্রিড একটি প্রবহমান বা অন্তর্বাহী ক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক তাই স্প্রে করার অল্প সময়ের মধ্যেই ইহা গাছের ভিতরে প্রবেশ করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছের রসের সাথে মিশে সম্পূর্ণ গাছটি বিষাক্ত করে তোলে। 

স্পর্শক

স্পর্শ ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় কীট-পতঙ্গের শরীরে সরাসরি স্পর্শ করলে বিষক্রিয়া ঘটে। 

পাকস্থলীয়

ইহা পাকস্থলীয় ক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক। তাই স্প্রে করা পাতা, ডগা ইত্যাদি থেকে রস খেলে পোকার শরীরে বিষক্রিয়া ঘটে৷ 

ট্রান্সলেমিনার

এটি ট্রান্সলেমিনার গুণসম্পন্ন কীটনাশক তাই পাতার উপরের স্তরে পড়লে তা পাতার এপিডার্মিস ভেদ করে পাতার নিচের স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম। তাই যে সকল পোকা পাতার নিচে লুকিয়ে থেকে রস চুষে খায়, তাদের শরীরেও বিষক্রিয়া ঘটে। 

ইমিডাক্লোপ্রিড পোকার শরীরে কীভাবে কাজ করে

ইমিডাক্লোপ্রিড হচ্ছে নিওনিকোটিনয়েড গ্রুপের কীটনাশক যা কীট-পতঙ্গের Nerve বা স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে। 

এটি কীট-পতঙ্গের শরীরে স্পর্শ করলে বা তারা চুষে খেলে তাদের শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়। ইমিডাক্লোপ্রিড স্নায়ুর স্বাভাবিক সংকেত পাঠানোর ক্ষমতাকে ব্যাহত করে এবং স্নায়ুতন্ত্র যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

এর ফলে কীট-পতঙ্গের প্রতিটি অঙ্গের কাজ করার ক্ষমতা লোপ পায় এবং অসাড় হয়ে মারা যায়। 


ইমিডাক্লোপ্রিড কোন কোন পেকা দমন করে

ইমিডাক্লোপ্রিড অসংখ্য অগুনিত পোকা দমন করে, যার আলোচনা সম্ভব নয়, তবে অল্প কিছু গোত্র ও পরিচিত পোকা সম্পর্কে আলোচনা না করলেই নয়। 

এফিড (Aphid)

এরা ক্ষুদ্র প্রকৃতির শোষক পোকা, গাছের রস খেয়ে বেচে থাকে তাই এদের গাছের উকুনও বলা যেতে পারে। সাদা মাছি, সবুজ মাছি, কালো মাছি নামেও পরিচিত। 

এদের ৪,৪০০ টি প্রজাতি রয়েছে, তার মধ্যে ২৫০ টি প্রজাতি কৃষি ক্ষেত্রের জন্য খুব ভয়ানক বালাই। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এদের আক্রমণ বেশি হয়। 

থ্রিপস পোকা

উকুনের মতো ক্ষুদ্র পোকা, সকল ধরনের সবজি, মাঠ ফসল ও মশলা জাতীয় ফসলে আক্রমণ করে।

জ্যাসিড

জ্যাসিড বা শ্যামা পোকা দমনেও এটি ভালো কাজ করে। 

কারেন্ট পোকা

এটি প্রবহমান গুণসম্পন্ন হওয়ায় কারেন্ট পোকাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 

ফলের মাছি পোকা 

কুমড়াজাতীয় সবজি এবং অন্যান্য ফলের মাছি পোকা যেহেতু গাছের রস খেয়ে বেচে থাকে, তাই তাদের দমনের জন্যও এটি কাজ করে। 

জাব পোকা

জাব পোকা হচ্ছে আমাদের সকলের একটি পরিচিত পোকা। এটি দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড এর তুলনা নাই৷

ধানের নেমাটোডা দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড

আবদ্ধ জলাশয়, নালা অথবা ধান খেতের স্বচ্ছ পানির নিচে এক ধরনের নেমাটোডা দেখা যায়, যেটি কেচোর মতো দেখতে তবে খুবই চেকনা, লাল সুতার  মতো দেখায়। অর্ধেক শরীর মাটির নিচে এবং বাকিটা উপরে নড়াচড়া করে। 

এটি কোন ক্ষতি করে কি না সঠিক জানা নাই, তবে চাষিরা বিব্রতবোধ করে। এগুলো দমন করার জন্য বিঘায় ৫০ মিলি ইমিডাক্লোপ্রিড প্রয়োগ করলেই হয়। 

এছাড়াও হপার, মিলিবাগ, রাইস বোরার্স, প্ল্যান্টপার্পারস, বিটল সহ চেনা-অচেনা বহু পোকা দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড মাহের। 

সাধারণত এ সকল শোষক পোকা দৈনিক তাদের শরীরের ওজনের ৩ থেকে ২০ গুণ রস শোষণ করে। কেনটা আবার ৮০ গুন পর্যন্তও রস শোষণ করতে পারে। গাছের শরীর থেকে সমস্ত খাদ্য ও রস চুষে নেওয়াতে গাছ একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। 

তাই এদের ক্ষুদ্র ভেবে হালকাভাবে নেয়া মোটেও উচিত নয়। এদের বাচ্চা বা ডিমও (নিম্ফ) ক্ষতিকর।

ভাইরাস এবং রোগ ছড়ানোর জন্য মূলত এই সকল শোষক পোকাই দায়ী। আর এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড হচ্ছে খুবই সস্তা এবং কার্যকরী একটি ওষুধ। 

এটি ল্যাদা জাতীয় পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা সহ অন্যান্য কুরে খাওয়া পোকা দমনে সফলভাবে কাজ করে না। তাই এগুলো দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড উপযুক্ত নয়। 


ইমিডাক্লোপ্রিডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ইমিডাক্লোপ্রিড খুবই শান্ত প্রকৃতির একটি ঔষধ। পানিতে মিক্স করলে তা তেমন ঘোলাটে করে না। এমন কি অন্যান্য কীটনাশকের সাথে মিক্স করলেও এটি কোন খারাপ বিক্রিয়া করে না। তাই অর্গানোফসফেট (টাফগরজাতীয়), পাইরিথ্রয়েড (সাইপারমেথ্রিনজাতীয়), কার্বামেট (কার্বোসালফানজাতীয়) কীটনাশকের সাথে মিক্স করে স্প্রে করলে বিপরীত কোন ক্রিয়া করে না। 

তাই এটা এ জাতীয় সকল কীটনাশকের সাথে মিক্স করে স্প্রে করা যায়। 


বিষাক্ততা

ইমিডাক্লোপ্রিড খুব দ্রুত কাজ করলেও এটি মাটি এবং পানি খুব কম দূষিত করে। মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য এর বিষাক্ততা খুব কম।  কীট-পতঙ্গ ও অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জন্য এটি খুব বিষাক্ত। 

মৌমাছির জন্য এটি খুব ক্ষতিকর। 


যেহেতু এটি বহুল ব্যবহৃত একটি কীটনাশক, তাই বহু কোম্পানি থেকে বিভিন্ন নামে এটি মার্কেটে পাওয়া যায়। 

নিচে ব্যাপক ব্যবহৃত কিছু বাণিজ্যিক নাম দেয়া হলো। 

ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশকের তালিকা

বানিজ্যিক নামকোম্পানি
টিডো/ টিডো প্লাসএসিআই
ইমিটাফঅটো ক্রুপ কেয়ার
এডমায়ার/কনফিডরবায়ার
মুক্তিইয়ন এগ্রো
জাদীদইনতেফা
কিংক্লোরপ্রিড/ফোটিকরেভেন এগ্রো
আমাডরআমানা এগ্রো
লিমিডোরদি লিমিট এগ্রো
ক্যানোপিমিমপেক্স
সাপ্টাগ্লোবাল এগ্রোভেট
প্রিমিয়ার/ক্যাপচাহেকেম বাংলাদেশ
পুতিনএগ্রি সোর্স লিমিটেড
ডাইমেগ্রোসীট্রে
কৃষক বন্ধুজেনেটিকা
গেইনম্যাকডোনাল্ড
মাত্রা ও ব্যবহার বিধি

সাধারণত স্প্রে করার মাধ্যমে এটি গাছে প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি মাটিতেও প্রয়োগ করা যায়। এর ফলে মাটিতে অবস্থানরত পোকা মারা যায় এবং শেকড়ের মাধ্যমে এটি গাছে প্রবেশ করে গাছও বিষাক্ত হয়ে যায়। 

এছাড়াও এটি বীজ ড্রেসিং এর কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। 

ইমিডাক্লোপ্রিড 20 SL লিকুইড সাধারণত সবজি ও মাঠ ফসলে প্রতি লিটার পানিতে  0.5 ml  অনুপাতে ব্যবহার করার জন্য সাজেস্ট করা হয়ে থাকে। তবে অবস্থাভেদে বিভিন্ন ফল গাছ অথবা অন্যান্য ট্রিটমেন্টে বিভিন্ন মাত্রায় সুপারিশ করা হয়ে থাকে। 

ইমিডাক্লোপ্রিড 70wdg এর ২ গ্রাম = ৭ মিলি লিকুইড ইমিডাক্লোরপ্রিড 20sl এর সমপরিমাণ। তাই এটি ১৪ লিটার পানিতে ব্যবহার করা যায়।


১টি মন্তব্য

অবাঞ্চিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন