সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পরিচিতি
সাইপারমেথ্রিন হচ্ছে Contact বা স্পর্শক এবং Stomac বা পাকস্থলী ক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক৷ সুর্যমুখী ও ডালিয়া জাতীয় ফুলের বীজ ও পাপড়ি থেকে পাইরেথ্রইয়েড সংগ্রহ করে কেমিক্যালী Modify করে সাইপারমেথ্রিন তৈরি করা হয়। কৃষিক্ষেত্র এবং বাসা-বাড়ির পোকামাকড় দমনে বিশ্বব্যাপি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়াও এটি গবাদিপশু পাখি চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা হয়।
![]() |
সাইপারমেথ্রিন |
কৃষিক্ষেত্রে এটিকে একটি আদর্শ কীটনাশক বলা যেতে পারে। কারণ প্রায় সকল ধরনের গাছে এটি প্রয়োগ করা যায় এবং প্রায় সকল ধরনের পোকার জন্য এটি দ্রুত, ভালো কাজ করে। দামেও সাশ্রয়ী।
সাইপারমেথ্রিন কী?
সাইপারমেথ্রিন একটি সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশক। পাইরেথ্রইয়েডকে প্রক্রিয়াজাত করে সাইপারমেথ্রিন তৈরি করা হয়।
সাইপারমেথ্রিন কীভাবে কাজ করে?
এটি হচ্ছে Contact বা স্পর্শক এবং Stomac বা পাকস্থলী ক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক৷ সরাসরি পোকামাকড় বা কীট-পতঙ্গের গায়ে পড়লে তা মারা যায় এবং প্রয়োগকৃত গাছের পাতা, ফুল-ফল, ডগা কুরে খেলেও পোকা মারা যায়।
এটি নিউরোটক্সিক হিসেবে কাজ করে। স্নায়ুকোষ, নিউরন, নার্ভাস, টিস্যু এবং বিশেষভাবে স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
যার ফলে এর বিষাক্ততায় হাটা-চলা, দেখা-শোনা, স্বাদ নেয়া, খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি nerve system এর সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে paralysis হয়ে মৃত্যু হয়।
সাইপারমেথ্রিন প্রয়োগক্ষেত্র
এটি বহু ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়৷ কৃষিক্ষেত্রে বহুকাল ধরে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় দমনে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷ যেমন :
ফলের মাছি পোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন
লাউ, করলা, শসা, ঝিঙা ইত্যাদি সকল প্রকার কুমড়াজাতীয় ফল, আম লিচু, পেয়ারা সহ বহু ধরনের ফলের একটি আতঙ্কের নাম হচ্ছে Fruit fly বা ফলের মাছি পোকা। এটি দমনে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সাইপারমেথ্রিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বিটল পোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন
কুমড়াজাতীয় গাছের রেড পামকিন বিটল দমনে এটি ভালো কাজ করে।
জাবপোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন
স্পর্শক গুণসম্পন্ন হওয়ায় জাবপোকা দমনে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন
পাকস্থলীয় গুন থাকায় ফলে প্রয়োগকৃত গাছের পাতা, ফুল, ফল, ডগা খাওয়ার ফলে বেগুন, শিম ও অন্যান্য গাছের ছিদ্রকারী পোকা মারা যায়।
আমের হপার দমনে সাইপারমেথ্রিন
আম গাছের হপার দমনেও এটি বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে৷
কুমড়াজাতীয় গাছের কচি পাতায় অনেক সময় ছোট মশা জাতীয় পোকা দেখা যায় সম্ভবত এগুলোকে Mosquito bug বা Helopeltis বলা হয়। কচি পাতার রস খেয়ে বাচে, আক্রান্ত পাতা বড় হলে ছিদ্র হয়ে যায়। এগুলো দমনেও এটি বেশ কাজ দেয়৷ এছাড়াও বিছা পোকা, লেদা পোকা, গান্ধি পোকা সহ জানা-অজানা বহু পোকা দমনে এটি কাজ করে।
সাইপারমেথ্রিন সাধারণত ১০ ইসি লিকুইড হিসেবে বেশি পাওয়া যায়। কচি চারাগাছে এবং ফুল-ফল থাকা অবস্থায় মাত্রা অনুযায়ী দিলে গাছ পুড়ে যাওয়া আর ফুল ঝরে যাওয়ার তেমন আশঙ্কা থাকে না।
কাঁকড়া দমনের জন্য অনেকে ইন্ডিয়া থেকে Import করা সাইপারমেথ্রিন- "সুপার কিলার, ইজিকট, কৃপকট, মেসি" ইত্যাদি বহুল পরিমাণে ব্যবহার করে থাকে। এগুলোর ঝাঁঝালো গন্ধ এবং কার্যকারিতা আরো বেশি বলে মনে করেন সবাই৷ অনেকে এগুলোকে তেলবিষ বলে চিনে থাকে।
সারের সাথে মিশিয়ে বিঘাপ্রতি ১০০-১৫০ মিলি প্রয়োগ করলেই প্রায় সকল ধরনের পোকা মারা যায়।
পুকুরে হাঁস পোকা সহ অন্যান্য পোকা দমনে স্বল্পমাত্রায় দারুণ কার্যকরী। মাছের উকুন মহামারি পর্যায়ে চলে গেলে দারুণ/এবামেকটিনের সাথে এটি প্রয়োগ করতে দেখা যায়। অল্প খরচে কাজ সাধন করার জন্য এটি ব্যবহার করে।
তবে মাত্রা বেশি হয়ে গেলে মাছের জন্য এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে৷ মাছ মারাও যেতে পারে।
বাসাবাড়ি, রান্নাঘর যদি দুষ্টু পিঁপড়ায় দখল করে নেয়, অথবা গাছের কচি ফুল-ফলে এদের ক্ষতিকর কোন অ্যাক্টিভিটি কনফার্ম হওয়া যায়, তাহলে সাইপারমেথ্রিনের চেয়ে বড় কোন ঔষধ নাই এদের দমনের জন্য। ২/১ মিলি লিটার হলেই যথেষ্ট।
সাইপারমেথ্রিন লার্ভিসাইড হিসেবে কাজ করে। মশা-মাছির লার্ভা নষ্ট করার জন্য তাদের জন্মস্থানে প্রয়োগ করতে হবে৷
এছাড়াও এটি WP বা পাওডার, SL, SC ইত্যাদি ফরমুলেশনেও পাওয়া যায় যেগুলো গার্হস্থলী কাজে পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা ইত্যাদি পোকামাকড় দমনে ব্যবহৃত হয়।
গবাদি পশু, ভেড়া, হাস, মুরগীকে আক্রান্ত করে এমন বাহ্যপরজীবি নিয়ন্ত্রণেও এটি ব্যবহৃত হয়।
সাইপারমেথ্রিন প্রয়োগ পদ্ধতি ও মাত্রা
সবজি অথবা লতা জাতীয় গাছ, যেগুলোর পাতা নরম, দ্রুত বর্ধনশীল, এ জাতীয় গাছে সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি সাধারণত ১ মিলি / লিটার হারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
আর যে সকল ফল গাছ, ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের পাতা মোটা, শক্ত সহনশীল সেগুলোতে সর্বেচ্চো দেড় থেকে ২ মিলি লিটার পর্যন্ত প্রয়োগ করা যায়।
এটি প্রয়োগের পর ১ সপ্তাহ পর্যন্ত কার্যকারিতা থাকে৷
অতিরিক্ত সূর্যালোক, অক্সিজেন এবং পানির সংস্পর্শে এর কার্যকারিতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
ক্রস প্রতিক্রিয়া
অন্যণ্য সাধারণ কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করা যায়৷ তবে এর সাথে একাধিক কীটনাশক ব্যবহার করতে চাইলে প্রথমে সাইপারমেথ্রিন পানিতে গুলিয়ে নিয়ে পরে অন্যগুলো মেশালে উত্তম হবে।
বিষাক্ততা
সাইপারমেথ্রিন মানুষের জন্য মাঝারি ধরনের বিষাক্ত। তবে মৌমাছি, কীট-পতঙ্গ এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জন্য বেশি বিষাক্ত।
সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশকের বানিজ্যিক নাম ও কোম্পানির নামের তালিকা
বানিজ্যিক নাম | কোম্পানি |
---|---|
রিপকর্ড ১০ ইসিস | BASF |
রেলোথ্রিন ১০ ইসি | অটো ক্রপ কেয়ার |
কট ১০ ইসি | এসি আই ক্রপ কেয়ার |
লিম্পার ১০ ইসি | দি লিমিট এগ্রো প্রডাক্টস |
শেফা ১০ ইসি | ইনতেফা |
কৃপকর্ড ১০ ইসি | মর্ডান এগ্রো কেমিক্যাল |
মেসি ১০ ইসি | ক্লীন এগ্রোভেট |
সানমেরিন ১০ ইসি | ম্যাকডোনাল্ড |
সুরক্ষা ১০ ইসি | হেকেম বাংলাদেশ |
টপথ্রিন ১০ ইসি | ব্লেসিং এগ্রোভেট |
টাইপার ১০ ইসি | সুইট এগ্রোভেট |
জেনেথ্রিন ১০ ইসি | জেনেটিকা |
কিংথ্রিন ১০ ইসি | কৃষি ক্রুপ কেয়ার |
সাইপারমেথ্রিনের দাম
বর্তমানে রিপকর্ড ছাড়া প্রায় প্রতিটা কোম্পানির ১০০ মিলি সাইপারমেথ্রিন ৮০-১০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
৫০০ মিলি ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
সাইপারমেথ্রিনের অপকারিতা
সাইপারমেথ্রিন প্রয়োগে অপকারী এবং উপকারী সকল ধরনের পোকাই মারা যায়। এটি ব্যবহারের ফলে পোকা-মাকড়ের Resisted বা সহ্য ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
তাই ধান সহ কিছু কিছু নির্দিষ্ট ফসলে এটি ব্যবহারে অনুৎসাহ দেয়া হয়ে থাকে৷
যাই হোক, প্রতিটা জিনিসেরই কিছু অপকারী দিক থাকে। এটিও তার বিপরীত নয়। তাই আমরা সচেতনতার সাথে অভিজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করে ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনতে পারি৷
2 টি মন্তব্য
-
নামহীন ১৯ মার্চ, ২০২৪ এ ৩:২০ PM ভালো লাগল আপনাদের -
নামহীন ২৯ জুলাই, ২০২৪ এ ৩:২৫ PM রেণু পুকুরে প্রয়োগ করা যাবে কি?