বরবটি চাষ পদ্ধতি (বারোমাসি বরবটি চাষ পদ্ধতি)
বরবটি সারাবছর চাষ যোগ্য পুষ্টিকর সবজি। প্রায় সব ধরনের মাটিতে বরবটি চাষ করা যায়। তবে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি বরবটি চাষের জন্য ভালো। উঁচু জমিতে যেকোনো সময় বরবটি চাষ করা যায়।
বরবটি চাষের আধুনিক পদ্ধতি
বরবটি চাষের ক্ষেত্রে ভালো ভাবে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে। আবহাওয়া অনুযায়ী উন্নত জাতের বরবটি বীজ রোপণ করতে হবে এবং সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। আসুন জেনে নেই কীভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে বরবটি চাষ করতে হয়।
বরবটি চাষ উপযোগী জলবায়ু
অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রায় বরবটি ভাল জন্মে। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় বরবটি গাছ ভালো জন্মে।
বরবটি চাষে কেমন মাটি প্রয়োজন?
দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি বরবটি চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ ৫.৫ থেকে ৭.৫-এর মধ্যে হলে সেসব মাটিতে বরবটি চাষ করা যায়।
বরবটির পরিচিতি জাত সমূহ
বিএআরআই কর্তৃক অবমুক্তায়িত জাত বারি বরবটি-১। এছাড়াও বেশকিছু বেসরকারি বীজ কোম্পানি কর্তৃক বাজারজাতকৃত জাতসমূহ নিন্মরূপঃ
উফশী বরবটি – কেগর নাটকী
এটি উজ্জ্বল গাঢ়, সবুজ, মোলায়েম এবং সুস্বাদু। প্রতিটি বরবটি ৫০-৬০ সেমি: লম্বা এবং একত্রে ২-৩টি ধরে। এই জাতটি লীফ স্পট, পাউডারী মিলডিউ, ডাউনি মিলডিউ রোগ সহনশীল। কেগর নাটকী বরবটি ডিসেম্বর ও জানুয়ারি ব্যতীত সারাবছর পাওয়া যায়। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৮-১০ টন।
গ্রীন ফিল্ড বরবটি
এই জাতের বরবটির রং গাঢ় সবুজ। প্রতিটি বরবটি ১৮-২২ ইঞ্চি লম্বা এবং জাতটি লীফ স্পট, পাউডারী মিলডিউ, ডাউনি মিলডিউ রোগ সহনশীল। বীজ বপনের সময় মাঘ হতে চৈত্র মাস। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ১৫-২০ টন।
সাদা সুন্দরী বরবটি
এই জাতের বরবটির রং হালকা সবুজ। প্রতিটি বরবটি ১৮-২২ ইঞ্চি লম্বা এবং জাতটি লীফ স্পট, পাউডারী মিলডিউ, ডাউনি মিলডিউ রোগ সহনশীল। বীজ বপনের সময় মাঘ হতে চৈত্র মাস। বীজ বপনের ৩৫-৪০ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ১৫-২০ টন।
গ্রীন লং বরবটি
গ্রীন লং জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং দিবস নিরপেক্ষ জাত। এই জাতের বরবটির রং গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং ৫৫-৬০ সেমি: লম্বা। এটি মৃদু শীত সহনশীল, খেতে মোলায়েম এবং সুস্বাদু। ফাল্গুন মাস হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৭-৮ টন।
লাল বাদামি বরবটি
জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং বরবটির রং লালচে বাদামি। বরবটি ৪৫-৫০ সেমি: লম্বা। এটি খেতে মোলায়েম এবং সুস্বাদু। ফাল্গুন মাস হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৮-১০ টন।
বরবটি ওয়াই এল বি ৫৭০
জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং দিবস নিরপেক্ষ জাত। এই জাতের বরবটির রং উজ্জ্বল, গাঢ় সবুজ বর্ণের, সোজা এবং ৫৫-৬০ সেমিঃ লম্বা। খেতে মোলায়েম এবং সুস্বাদু। ফাল্গুন মাস হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজ বপনের ৪৫-৫০ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৬-৭ টন।
কেগর নাটকী বরবটি
কেগর নাটকী জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং বারোমাসি। বরবটির রং গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং খেতে সুস্বাদু, লম্বায় ৫০-৬০ সেমি:। ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজ বপনের ৫০-৫৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। এটি ভাইরাস সহনশীল জাত। একর প্রতি ফলন ৭-৮ টন।
লালবেনী বরবটি
লালবেনী জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং লাল রং এর। বরবটি ৪৫-৫০ সেমি: লম্বা এবং সুস্বাদু। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজের হার প্রতি শতাংশে ৩০-৪০ গ্রাম। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ১০-১২ টন।
তকি বরবটি
জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং দিবস নিরপেক্ষ। উজ্জ্বল, গাঢ় সবুজ, মোলায়েম ও বরবটি ৫৫-৬০ সেমি: লম্বা এবং সুস্বাদু। মৃদু শীত সহনশীল। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজের হার প্রতি শতাংশে ৩০-৪০ গ্রাম। বীজ বপনের ৪৫-৫০ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৭-৮ টন।
বনলতা বরবটি
বনলতা জাতটি দ্রুত ফলনশীল, উচ্চ ফলনশীল এবং দিবস নিরপেক্ষ। বরবটি নরম, লম্বা, সোজা এবং হারকা সবুজ বর্ণের। জীবন চক্রের শেষ সময় পর্যন্ত একই রকমের ফল দেয়। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। বীজের হার প্রতি শতাংশে ৩০-৪০ গ্রাম। বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। একর প্রতি ফলন ৪-৫ টন
বরবটি চাষে জমি তৈরি
জমি পরিষ্কার করে ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। সার মিশিয়ে জমি সমান করার পর তা বেড আকারে খণ্ড করতে হবে।
বেড তৈরি ও চারা রোপণ
বেডের আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও জমির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী লম্বা। প্রতি বেডের মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা থাকবে। নালার গভীরতা হবে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। নালার মাটি তুলে দুপাশের বেড উঁচু করে দিতে হবে। প্রতি বেডের মাঝে ৬০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে জোড়া সারি দাগ টানতে হবে। সেই সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার পর পর ১টি করে বীজ বুনে দিতে হবে। একই সময় পলিব্যাগে কিছু চারা তৈরি করে রাখলে যে-সব জায়গায় বীজ গজাবে না সেসব ফাঁকা জায়গায় পলিব্যাগের চারা রোপণ করে পূরণ করা যাবে। মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে সাধারণত বরবটির বীজ বোনা হয়।
বীজ হার
বরবটি চাষের জন্য শতাংশ ১০০-১২৫ গ্রাম, হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি বীজ প্রয়োজন।
বরবটি রোপণ পদ্ধতি
বাণিজ্যিক ও বাড়িতে বা বসার ছাদে বরবটি চাষ করা যায়। দুই ক্ষেত্রে গোপন পদ্ধতি ভিন্ন।
বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার
- বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার।
- জাত হিসেবে সারির দূরত্ব ১ মিটার বাড়ানো বা কমানো যায়।
বস বাড়িতে চাষের ক্ষেত্রে
বরবটি গাছে সার প্রয়োজন
বরবটি চাষে সার খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। জমি প্রস্তুতের সময় সার অল্প পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে। বরবটি চাষের জন্য সুপারিশকৃত সারের মাত্রা হলো:..
সারের পরিমাণ ( প্রতি শতকে)…
- ইউরিয়া – ১০০ গ্রাম
- টি এস পি- ৯০ গ্রাম
- এমওপি- ৭৫ গ্রাম
- গোবর- ২০ কেজি
বরবটিতে ইউরিয়া সার কম লাগে। ইউরিয়া সার না দিলে ফল ধরে, কিন্তু ইউরিয়া সার অযথা বেশি দিলে গাছ বেশি সবুজ ও ঝোপাল হয়, ফুল-ফল কম ধরে।
বরবটি গাছের পরিচর্যা
বরবটি চাষে রোপণ করার পরিচর্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ভাবে যত্ন না নেয়া হলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না। জমিতে সেচ ও পানি নিষ্কাশন, আগাছা পরিষ্কার ও মাচা বা বাউনি দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। খাটো জাতের বরবটি চাষে মাচা বা বাউনির প্রয়োজন হয় না।
বরবটি গাছে সেচ ও পানি নিকাশ
জমিতে পানির যাতে অভাব না হয় সেজন্য প্রয়োজন অনুসারে শুকনার সময় সেচ দিতে হবে। নালার মধ্যে পানি ঢুকিয়ে সেচ দিলে গাছের শিকড় সে পানি টেনে নিতে পারে। বৃষ্টির পানি যাতে আটকে না থাকে সেজন্য নালার আগাছাও পরিষ্কার করে দিতে হবে ।
বরবটি গাছে আগাছা পরিষ্কার
জমি সব সময় আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।
বরবটি গাছে মাচা বা বাউনি
চারা বড় হলে মাচা বা বাউনি দিতে হবে। ঠিকমতো বাইতে পারলে বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিন পরই ফুল-ফল ধরে। না হলে ফল ধরতে দেরি হয়ে যায়। প্রতি বেডের ঠিক মাঝখানে বা বরবটির দুটির সারির মাঝে বেডের দুপাশে ১.৫ মিটার লম্বা দুটি বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার মাথায় শক্ত জিআই তার টেনে বাউনির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সারিতে প্রতি দুটি বরবটি গাছের মাঝে একটি করে কাঠি বা কঞ্চি পুঁতে সেসব কাঠির মাথা জিআই তারের সাথে ইংরেজি ‘এ’ অক্ষরের মতো বেঁধে তার সাথে গাছ লতিয়ে দেয়া যেতে পারে। বরবটির জন্য বাউনি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বরবটির লতা যত বেশি মুক্তভাবে বাইতে পারে তত বেশি ফলন বাড়ে।
বরবটি গাছে রোগ দমন
বরবটি যে সব রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় তা হলো নেতিয়ে পড়া রোগ ও পাউডারী মিলডিউ। রোগ প্রতিরোধক জাত ব্যবহার করে এসব রোগ দমন করা যায়।
বরবটি গাছে পোকা মাকড় দমন
যে সব পোকা মাকড় দ্বারা বরবটি আক্রান্ত হয়, তা হলো বিছা পোকা, জাব পোকা, থ্রিপস এবং ফলের মাজরা পোকা। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব পোকা দমন করা যায়।
কীটনাশক ব্যবহার
গাছে ফুল আসলে জমিতে নিচের কীটনাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
- ছত্রাকনাশক(ম্যানকোজেব + মেটালেক্সিল/ কার্বেন্ডাজিম) সপ্তাহে একবার।
- এমামেকটিন গ্রুপের কীটনাশক সপ্তাহে একবার।
- মাকড় নাশক( এবামেকটিন) ২ সপ্তাহে একবার।
- ইমিডাক্লোরোপ্রিড ২ সপ্তাহে একবার।
- বলবান (৪ সিপিএ) ১০ দিন পর পর ২-৩ বার।
- চিলেটেড জিংক ১০ দিন পর পর ২-৩ বার।
টবে বরবটি চাষ
দেশে সাধারণত শখের বসে বা পরিবারের সবজির চাহিদা মেটাতে অনেকেই বাসার ছাদের টবে সবজির চাষাবাদ করে থাকে,।
টবে বারোমাসি সবজি বরবটির চাষ করার জন্য ৪০% সাধারণ মাটি, ২০% বালি, ২০% জৈব সার (ভার্মি কম্পোস্ট), ২০% কোকোপিট এর একটি সুনিষ্কাশন (Well Drain) মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে।
যে টবটি নেবেন তার নিচে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য টবটির নিচে কয়েকটি নুড়ি রাখতে হবে।
তার উপরের স্তরে কিছুটা বালি দিতে হবে। এরপর মাটির মিশ্রণটি দিয়ে টব ভরাট করতে হবে।
বরবটি কখন তুলতে হবে?
বীজ বোনার ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর থেকেই বরবটি তোলা শুরু করা যায়। হাত দিয়ে বোঁটা ছিঁড়ে বরবটি তোলা যায়। তবে ছুরি দিয়ে বোঁটা কেটে তোলা ভালো। এতে গাছের ক্ষতি কম হয়। কচি অবস্থায় ফল তুলতে হবে। যখন দেখা যাবে ফলে বীজ গঠিত হয়েছে কিন্তু বীজ পুষ্ট ও পরিপূর্ণভাবে বড় হয়নি, খোসার রং স্বাভাবিক সবুজ আছে, বরবটির খোসা মসৃণ আছে, বীজ ফুলে যাওয়ায় বরবটি গিঁট গিঁট ও কুঁচকানো হয়নি এরূপ অবস্থায় বরবটি তুলতে হবে।
বরবটির ফলন কেমন হয় ?
হেক্টরপ্রতি ১৬ থেকে ১৭ টন বরবটি সংগ্রহ করা যায়। পরিচর্যা উপর ফলন কেমন পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে।
কখন বরবটি চাষের উপযুক্ত সময়?
বরবটি সারাবছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে ফলন ভালো হয়। শীত মৌসুমে তুলনামূলক ফলন কম হয়।
বর্ষাকালে বরবটি চাষ করা যায় ?
হ্যাঁ। বর্ষাকালেও বরবটি চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে উঁচু জমি নিবার্চন করতে হবে, যাতে পানি জমে না থাকে।
আর্টিকেলের সকল তথ্য বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক ওয়েবসাইট ও ফেসবুক গ্রুপ থেকে সংগৃহীত।